হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্নের খুব কাছে…
প্রাণহীণ দুটি পা নিয়ে স্বপ্ন বুনে চলছেন অবিরাম ভাবে; একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন মহসিন। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন যার মনে, শারীরিক অক্ষমতা কি তাকে বেধে রাখতে পারবে? মাত্র ৬ বছর বয়সে দুটি পা হারিয়ে এখন তার একমাত্র ভরসা হুইলচেয়ার। এই হুইলচেয়ারে বসেই এখন স্বপ্নের খুব কাছে মহসিন। পড়াশুনাটা হয়নি ঠিকঠাক মতো। ক্রিকেটে স্বপ্ন পূরণের পথ চলার সঙ্গে পড়াশুনার চাপটাও নিয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে। তার স্বপ্নের রাজ্যে স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে সাফাও বসবাস করছেন। তিলে তিলে মনের ভেতর লালন করা স্বপ্নটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছে টঙ্গী থানার মরকুন গ্রামের ছেলে মো. মহসিনের। নিজের স্বপ্ এবং বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে কথা বলেছেন-
মহসিনের পথ চলার গল্পটা অনেক কঠিন ছিল। স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে থাকে। অসাড় ২টি পা নিয়ে ভাবতেন হুইলচেয়ারে কি ক্রিকেট খেলা যাবে! আমার মতো কেউ কি আছে; যাদের অন্তঃপ্রাণ ক্রিকেট। এই ভাবনা থেকেই মূলত বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ (বিসিএএফসি) সংগঠনটির জন্ম। শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে মহসিনের চোখ দুটি চিক চিক করে উঠছিল। তিনি বলেছেন, ‘২০১১ সালে আমি ভাবছিলাম আমার মতো হুইলচেয়ার নিয়ে কেউ ক্রিকেট খেলতে আগ্রহী কিনা। হঠাৎ একদিন আমি হুইলচেয়ার অনুশীলনের একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করি। ওই ছবি দেখে ভারত থেকে এক লোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। মূলত ওখান থেকেই আমার মাথায় চিন্তাটা আরও প্রসারিত হয়। আমি অনেকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। কাউকে না পেয়ে আমি ব্লাইন্ড ক্রিকেট নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওরাও একুটু উৎসাহ দেয়। ওদের সঙ্গে ৩/৪টি মিটিং করি। কিন্তু ওরা জানায় ৭০-৮০ হাজার টাকা লাগবে এই সংগঠনটা দাঁড় করাতে। এতো টাকার কথা শুনে আমি সরে আসি ওখান থেকে। স্বপ্নটা বুঝি মারা যাবে, এমন ভয় উঁকি দিচ্ছিল মনে।’
মাঝে কিছুক্ষন থেমে আবার কথা বলা শুরু করলেন মহসিন। তিনি বলেছেন, ‘আমার পরিচিত এক বড় ভাই সিআরপিতে আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের দলটাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ পাঠাই। ২০১৩ সালে ১৬ মার্চে ৩টি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলি ভারতের দলের সঙ্গে। এরপর জাবেদ ভাইয়ের মাধ্যমে ক্রিকেট বোর্ডের আকরাম খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়সহ অনেকের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আমি কথা বলি।’
বর্তমান কর্মকান্ড নিয়ে মহসিন বলেছেন, ‘২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে এশিয়া কাপ শুরু হবে। আমাদের দলটাকে শক্তিশালী করার জন্য ৪টি জেলা থেকে ভাল খেলোয়াড় বাছাই করেছি। ২৫ জন খেলোয়াড় থেকে ৬ জন সেরা খেলোয়াড় বাছাই করেছি। জানুয়ারির ২ তারিখ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক মাঠে ১৫ দিনের জন্য ক্যাম্প শুরু হবে।’
নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিআরসির উদ্যোগে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। ওখানে স্থানীয় কোচদের ৩দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা প্রদান করা হয়েছে। এই বিষয়ে মহসিন বলেছেন, ‘ক্রিকেট বোর্ড আমাদের বলেছে আমরা যে কাজ করব আমাদের তো কোন ধারনা নেই। তাই আইসিআরসি ইংল্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংল্যান্ড ফিজিক্যালি ডিজিবল দলের প্রধান কোচ ইয়ান মার্টিন ও কাসিম আলীকে বাংলাদেশে আনে। তারাই ওয়ার্কশপগুলোতে কাজ করেছেন। ওখানে আমাদের দলের সঙ্গে সাভারের সিআরপির একটা দলও ছিল।’
চলতি বছর জুনে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয় করে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দলের প্রত্যেক ক্রিকেটারকে পুরস্কৃত করেছেন। এই নিয়ে মহসিন বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় দলটাকে দেখ-ভাল করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আকরাম খানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এর আগে আমরা ভারতে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছি। জুনের ১৬ তারিখ প্রধানমন্ত্রী আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছেন। সেদিনের এই অর্জনের জন্যই আজ এতোদূর পযন্ত এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমাদের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ১ লাখ করে টাক দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সংসদ ভবনের পাশে ৪ বিঘা খালি জায়গা আছে, সেখানে আমাদের একটা কমপ্লেক্স করে দেবেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ভারত-পাকিস্তানকে নিয়ে ত্রি-দেশীয় সিরিজ আয়োজন করার ব্যবস্থা করবেন তিনি। এবং এশিয়া কাপের পুরো খরচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহন করবেন।’
ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে এর মধ্যে কোনো কথা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এসেছিলেন বোর্ড সভাপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য। সভাপতি আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে বোর্ড আমাদের নিয়ে কাজ করবে। কিভাবে করলে ভাল হয় এই বিষয় নিয়ে এখন চিন্তা করছেন।’
জানুয়ারি মাসে এশিয়া কাপ খেলতে ভারত যাবেন, এখানে লক্ষ্যটা কি থাকবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘এশিয়া কাপে আমরাসহ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা দল খেলবে। আমরা আশা করি, এশিয়া কাপের শিরোপা আমরা জিততে পারব। আমাদের বর্তমানে যে খেলোয়াড়দের পেয়েছি তারা প্রত্যেকেই বেশ ভাল খেলোয়াড়।’ তিনি আরও যোগ করেছেন, ‘আমি বিশ্বমানের ফিজিকেল ডিসিবল ক্রিকেট দল গড়তে চাই।’
এই মুহূর্তে এখানে কোনো মন্তব্য নেই, আপনি কি একটি মন্তব্য দেবেন?
মন্তব্য লিখুন