দিদার বলীর শ্রেষ্ঠত্ব
গতবার সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১০ সেকেন্ড! অনেক দর্শক সেবার ফাইনালে বলীদের বিশেষ করে দিদারের কসরত দেখা থেকে বঞ্চিত হন। এবার দর্শকদের আগাম সতর্কতা, না জানি মিস হয়! না মিস হয়নি দর্শকদের, দর্শকদের হতাশ করেননি দিদার বলী। জব্বারের বলী খেলার সাথে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলায় দর্শক থেকে শুরু করে অন্যান্য বলীরাও যেন আসেন দিদার বলীর শ্রেষ্ঠত্ব দেখতে।
আজ জব্বারের বলী খেলার ১০৬তম আসরে আবারও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন দিদার। ১২তম বারের মতো রামুর দিদার বলী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপার (যার মধ্যে ৭ বার এককভাবে চ্যাম্পিয়ন, পাঁচবার যৌথভাবে) স্বাদ গ্রহণ করে জানান দিলেন বাংলাদেশে তাকে হারানোর মতো বলী এখনো আসেননি।
লালদিঘী পাড়ের চারপাশ ব্যবসায়ীরা শীতল পাটি, হাতপাখা, ফুলের ঝাড়ু, পোড়া মাটির বাঘ-হাতি, কাঠের পুতুল, রেশমি চুরি নিয়ে রাঙিয়ে তুলেছে অপরূপ সাজে। লালদিঘীর চারপাশে রাস্তাঘাটে যতদূর দুচোখ যায় শুধু বৈশাখী মেলার আবহ। ১০৫ বছর ধরে লালদিঘী পাড়ে বৈশাখের ১১, ১২, ১৩ এই তিনদিন গোটা বাংলার মানুষ মাতোয়ারা থাকে গ্রামবাংলার অতীত ঐতিহ্যে ভরপুর বৈশাখী মেলায়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বাংলার ১৩১৬ সালের ১২ বৈশাখ (ইংরেজি ১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল) বলীখেলা বা মল্লযুদ্ধ দিয়ে সূচিত হয় এই বলী খেলা ও বৈশাখী মেলার। চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার সওদাগর (ব্যবসায়ী) আবদুল জব্বার এটি শুরু করেছিলেন বলে তার মৃত্যুর পর তার নামেই এই উৎসবের নামকরণ ‘জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা’। সেই থেকে প্রতিবছর বৈশাখের ১২ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় বলী খেলা।
বিকেল ৪টার আগেই দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে লালদিঘী ময়দান। মাঠে স্থান না পেয়ে আশপাশের ভবনের ছাদে অবস্থান নেন কৌতূহলী দর্শক। ঢাকঢোল বাজিয়ে বলীখেলার মঞ্চের চারপাশে ঘুরছিল বাদক দল। বিকাল ৪টায় দিকে ঢোলের তালে তালে শুরু হয় জব্বারের বলী খেলা। জব্বারের বলি খেলায় সারাদেশ থেকে আসা ১৫ থেকে ৭৯ বছর বয়সী প্রায় আশি জন বলী খেলা প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ডে অংশ নেন।
নক আউট পর্বশেষে বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় চ্যালেঞ্জ রাউন্ড। এতে অংশ নেন রামুর দিদার, নারায়নগঞ্জের হাবিবুর রহমান, মহেশখালীর হাশেম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি। প্রথম সেমিফাইনালে এ বছরের রানার্স আপ অলি বলী কক্সবাজার মহেশখালীর হাশেমকে পরাজিত করতে সময় নেন সাড়ে চার মিনিট। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মাত্র এক মিনিটে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের হাবিবুর রহমান বলীকে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠেন দিদার বলী। ফাইনালে শুরুতে দিদারকে বেশ করেয়কবার বেকায়দায় ফেলেন অলি বলী। কিন্তু তাতে একটু ঘাবড়ে যাননি অভিজ্ঞ দিদার বলী। আড়াই মিনিটের মাথায় আলীর কোমর ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলার সুযোগ খুঁজতে থাকেন দিদার। অবশেষে ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের মাথায় আলীকে পরাস্ত করেন দিদার।
জয়ের পর চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী বলেন, ‘সবার দোয়া আর ভালোবাসায় আমি বারবার ছুটে আসি জব্বারের বলী খেলায়। দর্শক-সমর্থকরা আশা করেন আমি যেন বারবার চ্যাম্পিয়ন হই। ওদের সম্মানার্থে আমি সারা বছর পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করি। আল্লাহ আমাকে বারবার জয়ী করেন।’ দিদার আরও জানান, তিনি প্রতিদিন দেশী মুরগী, কবুতর, ডিম ইত্যাদি খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মমেনে অনুশীলন করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অলি বলেন, ‘সেমিফাইনালে অনেক সময় নিয়ে খেলার পরপরই আমাকে ফাইনালে দিদারের বিপক্ষে নামতে হয়। কিছুটা ক্লান্তি নিয়ে ফাইনাল খেলি। তাই দিদার বলী আমাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে আগামীবার আমি চ্যাম্পিয়ন হবো ইনশাহ্আল্লাহ।
খেলা শেষে বিজয়ী দিদার বলী ও অলি বলীর হাতে নগদ ১৫ হাজার ও ১০ হাজার টাকা এবং ট্রফি তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এছাড়া প্রথম রাউন্ডে জয়ী সবাইকে দেয়া হয় ১ হাজার টাকা করে নগদ পুরস্কার।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আয়োজক কমিটির সভাপতি জহরলাল হাজারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলালিংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক সৌমেন মিত্র, নগর পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ) কামরুল আমিন, জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার প্রমুখ।
শওকত আনোয়ার বলেন, ‘নতুন নতুন বলী আসার জন্য আমরা ভবিষ্যতে নতুন পদক্ষেপ হাতে নিব। প্রয়োজনে দিদার বলীকে অবসর নেয়ার জন্য বলব, যাতে নতুন কেউ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। গতবারের সামান্য কিছু বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য এবার আমরা দর্শক-সাংবাদিকদের জন্য আলাদাভাবে মঞ্চ তৈরি করেছি। নির্বাচনী ডামাঢোলের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বলী খেলায় সমাপ্ত হওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।’
বরাবরের মতো এবারও খেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আবদুল মালেক। যিনি ১৯৮৭ সাল থেকে জব্বারের বলি খেলার বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তবে নির্বাচনী প্রচারণা না চালিয়ে এবারে সময় দেয়াটা সবার কাছে অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে।
এদিকে, জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষ্যে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে তিনদিনের বৈশাখী মেলাও। লালদীঘির মাঠ থেকে দক্ষিণে কোতোয়ালী মোড়, উত্তরে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে মেলা। প্রতিবারের মতো এবারও বৈশাখী মেলায় হরেক রকম পসরা নিয়ে ভিড় করেছেন দোকানিরা।
এই মুহূর্তে এখানে কোনো মন্তব্য নেই, আপনি কি একটি মন্তব্য দেবেন?
মন্তব্য লিখুন